সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ শয়তানের ধান্ধায় পড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।তাই যুগে যুগে মহান আল্লাহ মানুষকে সুপথে পরিচালনা করার জন্য নবী-রাসূল আম্বিয়ায়ে কেরাম ও হক্কানী আলেম-উলামাদের প্রেরণ করেছেন।যারা নিজ নিজ কর্ম ও সাধনা দ্বারা অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে মহান আল্লাহর নির্ধারিত পথে পরিচালনা করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়েছেন। একই সাথে গণমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন।

তাঁরা স্বীয় ঈমান-আকিদায় অটল রয়েছেন,ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করেছেন। কখনো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি।কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েও অটল-অনঢ় রয়েছেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসরণ করে গেছেন।সেসব বীর মুজাহিদের মধ্যে আল্লামা শায়খ ইউনুস আলী রায়গড়ী রাহ. অন্যতম।

আজীবন ইসলামের খেদমতের জন্য তিনি দেশেবিদেশে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং তাঁর অসংখ্য মুরিদ,হিতাকাঙ্খী,কৃতি ছাত্র গোটা বাংলাদেশ,ভারত ও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।

এ নির্ভীক সৈনিক দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে নিজ জীবন গঠন, ঈমান-আমলের মেহনত তথা গোটা জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার কাজে ছিলেন ব্যস্ত।পরিবার, সমাজ,রাষ্ট্র পর্যন্ত খোদা প্রদত্ত বিধান প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।তিনি ছিলেন সত্যের সামনে কোমল আবার অসত্যের সামনে ইস্পাতের ন্যায় কঠিন।

হযরত শাহাজালাল রহমাতুল্লাহ আলাইহি ও তদীয় ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত সিলেটের এ উর্বর মাটিতে তিনি আজীবন আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে লড়ে গেছেন সকল বাতিলের মোকাবেলায়।

১৯৩১ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি তারিখের শুভ প্রভাতে এ ক্ষণজন্মা মুজাহিদের জন্ম হয-় সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের রায়গড় গ্রামে-এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা-মাতা উভয়ই ছিলেন খুবই ধার্মিক ও পরহেজগার। জন্মের পর পরই তাঁর স্নেহময়ী জননী ইন্তেকাল করেন।

মাতার অবর্তমানে গ্রামের মক্তবেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়।

এখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

অতঃপর তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুরু আল্লামা আব্দুর রহিম শেরপুরী রাহ.এর তত্ত্বাবধানে ইলমে সরফ, নাহু, বালাগাত, ফেক্বাহ প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।

এরপরই তিনি উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের জামে আজহার নামে খ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন।

সেখানে দুই বছর উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে এলও শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর আমন্ত্রণে আবার দেওবন্দ চলে যান। কারণ হযরত মাদানী রাহ. তাঁর তাক্বওয়া ও ইলমের প্রসারতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেখানে পূর্ণ এক বছর শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.এর তত্ত্বাবধানে কঠোর সাধনা,রিয়াজত ও মুজাহাদার মাধ্যমে তরিক্বতের উচ্চ আসনে সমাসীন হলে মুর্শিদ তাঁকে খেলাফতের মহান দায়িত্ব অর্পণ করেন।

দেওবন্দ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে এসে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায়  শিক্ষকতা করার পর ১৩৭৮ হিজরী সনে ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৪০১ হিজরী সনে তাঁর শিক্ষা গুরু আল্লামা শেরপুরী রাহ. চাপে এবং মজলিসে শূরার অনুরোধে মূল এহতেমামির দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হন।

তখন থেকে আমৃত্যু সুদীর্ঘ ১৯ বছর কাল এখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত, সত্য ও কর্মনিষ্ঠা,আমানত ও দিয়ানত, যোগ্যতা ও পারদর্শিতার মাধ্যমে মাদ্রাসা পরিচালনার এ মহান গুরুদায়িত্ব,সুচারু ও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেন। মাদ্রাসার তা’লীম তারবিয়্যাত বিল্ডিং ইমারতসহ দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট দারুল হাদীস ভবনসহ সর্বক্ষেত্রে সার্বিক উন্নতি উৎকর্ষ তাঁরই হাতে সাধিত হয়।

তাঁর অগণিত ছাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন।

ইসলামের এ মহান সাধক ও খেদমতগার তাঁর অসংখ্য ভক্তকুল, মুরিদান ও সাগরিদান ও আত্মীয়-স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৪১৯ হিজরীর পবিত্র আশুরার রজনীতে আনুমানিক ২:৩০ মিনিটের সময় সুনামগঞ্জের দিরাই থানার টুক দিরাই গ্রামে জনৈক মুরিদের বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পর দিন দশই মহররম বাদ আছর হাজার হাজার ভক্তকূল, ছাত্র, মুরিদানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় মাদ্রাসা ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাঠে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

তার কতিপয় কেরামত:

যেদিন তার মুর্শিদ হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.ইন্তেকাল করেন,সেদিন তিনি বাংলাদেশের বিয়ানীবাজারস্ত আঙ্গুরা-মুহাম্মদপুর মাদ্রাসায় ছিলেন।হঠাৎ করে তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। অনেকক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।তিনি বললেন, হায়! আজ পৃথিবী থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝরে গেল। তাঁর কথার মর্ম তখন কেহই বুঝতে পারলেন না।তারপর জানা গেল যে, কুতুবে আলম হোসাইন আহমদ মাদানী আর দুনিয়াতে নেই।

তার ইন্তেকালের পূর্ব রাত্রে একটি স্বপ্ন দেখেন, কুতুবে আলম সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. হাদীস উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. ও হযরত কারী তায়্যিব রাহ. আকাবিরীনে কেরাম তাঁর সাথে মুসাফাহা ও আমোদ করছেন।

পরদিন সকালে তিনি তাঁর খাদেমকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন এবং বলেন আমি হয়তো আর বেশি দিন নেই।কিন্তু কি আশ্চর্য! পরদিন তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়ে যায়।তিনি এ নশ্বর ধরাধাম ত্যাগ করে স্বীয় মুর্শিদের সান্নিধ্যে চলে যান।

মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব বলেন যে, একবার তিনি হযরত ইউনুস রাহ. এর সঙ্গী ছিলেন।রাত প্রায় ৮ ঘটিকার সময় তাদেরকে খরস্রোত পিয়াইন নদী পাড়ি দিতে হয়েছিল। পাহাড়ী পিয়াইন নদীতে ঢল নেমেছে। স্রোতের তান্ডব সামনে যা পাচ্ছে তাই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নৌকাও নেই, রাত্রিও অন্ধকার, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। এ অবস্থায় শেখ সাহেব রাহ. সাহস হারালেন না।বরং মৌলানা আব্দুল মান্নানকে বললেন কাপড় গুটিয়ে নাও এবং নির্ভয়ে আমার সাথে চল। তিনি নদীতে নামতে উদ্যত হলে মাওলানা আব্দুল মন্নান তাঁকে বাধা দিলেন, কিন্তু তিনি না থেমে তাঁর সাথে চলার জন্য নির্দেশ দিলেন। অগত্যা মৌলানা আব্দুল মন্নানো তাঁকে অনুসরণ করলেন। সবিস্ময়ে হাটুজল ভেঙ্গে অল্পক্ষণেই তাঁরা নদী অতিক্রম করে ওপারে পৌঁছলেন।ফিরে তাকিয়ে দেখলেন নদীর জল কানায় কানায় ঠিকই ভরপুর আছে।আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, মাত্র ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করে তাঁর কাঙ্খিত বাড়িতে পৌঁছলেন।

আরো একবার তিনি মাওলানা আব্দুল মান্নানকে নিয়ে সিলেট শহরে এক বাসায় যান এবং সে বাসায় রাত্রিযাপন করেন। উক্ত বাশার একজনকে তদবির করেন জার আশা ডাক্তাররাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।পরে জানা গেল আল্লাহর মেহেরবানীতে সে রোগী ভালো হয়ে উঠেছিলেন।একই যাত্রায় তিনি মাওলানা আব্দুল মান্নানকে নিয়ে পায়ে হেঁটে মাত্র ১ ঘন্টায় ১৫ মাইল রাস্তা অতিক্রম করেছিলেন।

গোয়াইনঘাটের জনৈক ব্যক্তি হযরতের মাদ্রাসার সাহায্য দিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁকে অবহেলা করে বিদায় করেন।কিন্তু সাথে সাথে তার পেট ব্যাথা শুরু হয়। অনেক ঔষধ সেবন করেও রেহাই পেলেন না।অগত্যা হযরত শেখ সাহেব রাহ. এর শরণাপন্ন হয়ে মাদ্রাসার জন্য ১০ মন ধান দান করেন এবং তাঁর দোয়া চান। ফলে আরোগ্য লাভ করেন এবং আমৃত্যু হযরত শেখ সাহেব রাহ. কে অত্যন্ত সম্মান করতেন।

তার মৃত্যুর কিছুদিন পর রানাপিং মাদ্রাসার কারী শফিকুল হক সাহেবের কাছে জানা গেল হযরত রাহ. তাকে একটি জামা দান করেছিলেন। একরাত্রে ক্বারী শফিকুল হক সাহেব উক্ত জামা পরিধান করে শয়ন করেন এবং স্বপ্নে রাসূল করীম সা. এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন।

আরো একদিনের ঘটনা জনৈক মাওলানা সাহেবের কাছ থেকে শোনা।তিনি তখন ছাত্র।একদিন উক্ত ছাত্র ও আরো একজন ছাত্রের উপর দায়িত্ব পড়ল তারা হযরত ইউনুস রাহ. কে জাফলং পৌঁছে দিবে। যথাসময়ে হযরত রাহ. কে সাথে নিয়ে তারা রওয়ানা দিল। রাস্তায় পড়লো খরস্রোতা পাহাড়ি নদী।নদীর স্রোত যা সামনে পাচ্ছে সবাই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।নদী পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কাপড় গুটিয়ে তাঁকে অনুসরণ করার জন্য হযরত রাহ. তাদের বললেন। তারা হযরত রাহ. কে অনুসরণ করলো। কিন্তু কী আশ্চর্য ! নদীর কানায় কানায় পানির অস্তিত্ব তারা টেরই পেলেন না।অল্পক্ষণ পর তারা বিস্ময়ের সহিত লক্ষ্য করলেন যে, ইতিমধ্যে ওপারে পৌঁছে গেছেন। হযরত রাহ. কে তারা বলল,ফিরে যাবার সময় আমরা নদী কিভাবে অতিক্রম করব? তিনি এক খন্ড কাগজ নদীতে ফেলে দিয়ে বললেন- যাবার সময় নৌকা পাবে। এ কথা বলে গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন। কিছুদূর যাবার পর আশাতীতভাবে একখানা গাড়ি এসে পড়লে তারা তাতে চেপে অতি অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছান।

ফেরার পথে সত্যিই তারা একখানা নৌকা অপেক্ষারত অবস্থায় পেলেন। এ নৌকায় করে তারা নদী পার হলেন। মাঝিকে পয়সা দিতে চাইলে, সে পয়সা নিতে অস্বীকার করলো। নৌকা থেকে উঠার পর ফিরে তাকিয়ে দেখেন- নৌকা বা মাঝি কোনটাই নেই।যেন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেছে।এভাবে সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক পূর্বেই তারা সকল মাদ্রাসায় পৌঁছলো।

এজাতীয় কেরামতের কথা কাকেও না বলার জন্য তিনি ছাত্রদের বলে দিয়েছিলেন। তাঁর ওফাতের পর তারা তা প্রকাশ করেছে। তাঁর প্রদর্শিত আরো অনেক কেরামত জানা থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধনের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এ স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা গেল না।

যিনি ইসলামের ঝান্ডা তুলে ধরে সারা জীবন বিপথগামী মানুষের হেদায়েতের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। আমরা সে ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

মোঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরী

বহু গ্রন্থ প্রনেতা,গবেষক ও সাহিত্যিক।

তাঁর লেখা-(ঈমান এক্বিন আমল বিষয়ক নিবন্ধ ৫) বই হতে সংগৃহীত।

সংগ্রহঃ শেখ আব্দুল্লাহ উসামা