নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালি জাতি যা চায়, তা আদায় করে নেয়। কারো কাছে চেয়ে বসে থাকে না। বাঙালি জাতি কখনো নিজের অপমান সহ্য করে না। আর তাই আজকের “২১ শে ফেব্রুয়ারি” “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে থেকে শুরু হয় বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে নিধন অভিযান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পর পর আঘাত করা হয় বাংলা ভাষার ওপর। তখন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এ কে ফজলুল হক। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বাঙালি জাতিকে শাসনের নামে শোষণের। এপ্রিল মাসে শুরু হয় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার একতরফা দাবি। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লিখেন। ২ রা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে দুই দিনের সম্মেলনে ” বাংলাকে শিক্ষা ও আইন আদালতের বাহন” করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।  ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলে গঠিত হয় “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”।  ঢাকা জুড়ে অনুষ্ঠিত হতে থাকে সভা সমাবেশ। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজি পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। তার অগ্রাহ্য হয়, ২৬ ও ২৯শে  ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ রা ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” পুনর্গঠিত হয়। ১১ই মার্চ “বাংলা ভাষা দাবি দিবস” পালন করা হয়। শুরু হয় “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত আন্দোলন। গ্রেফতার করা শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও অলি আহাদ সহ ঊনসত্তরজন ছাত্রজনতা। এর প্রতিবাদে ১২ থেকে ১৫ই মার্চ ঢাকায় পুনরায় ধর্মঘট পালিত হয়। ১৫ ই মার্চ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
২১শে মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন “উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। শুরু হয় অবিরাম আন্দোলন। প্রতিদিন বের হতো ছোটখাটো মিছিল, প্রত্যেক গাছতলায় বসতো মিটিং।
‘৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসভায় এসে জিন্নাহ’র পুনরাবৃত্তি করলে ৩০শে জানুয়ারি ধর্মঘট পালিত হয়। ৪টা ফেব্রুয়ারি ছাত্র বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি পুরো দেশব্যাপি “রাষ্ট্রভাষা দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। জনগণকে সামলাতে পাকিস্তান সরকার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও সহবন্দি মহিউদ্দিনকে ফরিদপুরে স্থানান্তর করা হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হয় খন্ড খন্ড মিছিল। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে এসে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। নিহত হন বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম সহ অসংখ্য ছাত্রজনতা। মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচনা করেন, “কাঁদতে আসিনি আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” এবং তরুণ কবি আল আজাদের “স্মৃতির মিনার” সহ অসংখ্য কালজয়ী কবিতা, গল্প উপন্যাস। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার দাবি, সুরক্ষিত হয় “মাতৃভাষা বাংলা”!  আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচনা করেন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” অমর সেই সৃষ্টি। আর সেই থেকে বাংলা শব্দটি আমাদের।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলতো। বাকী ৪৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে পশতু, বালুচ, সিন্ধি সহ বেশকিছু মানুষ উপজাতি ছিল। আর বাঙালি চেয়েছে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে। বাঙালি কোনো অন্যায় দাবি জোরকরে আদায় করে নি। বাঙালি তার ন্যায় সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সেই চেতনা থেকে আজকেও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ! বাঙালি জাতি!